প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন (সুন্দরবন)
বাংলাদেশের
দক্ষিণ অংশে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম
জোয়ারধৌত গরান বনভূমি (mangrove
forest)।
কর্কটক্রান্তির
সামান্য দক্ষিণে ভারত ও বাংলাদেশের উপকূল ধরে বিস্তৃত ২১°৩০´-২২°৩০´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°০০´-৮৯°৫৫´ পূর্ব
দ্রাঘিমার মধ্যবর্তী স্থানে এ বনের অবস্থান। নানা ধরনের গাছপালার চমৎকার সমারোহ ও
বিন্যাস এবং বন্যপ্রাণীর অনন্য সমাবেশ এ বনভূমিকে চিহ্নিত করেছে এক অপরূপ
প্রাকৃতিক নিদর্শন হিসেবে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের একটি উলেখযোগ্য কেন্দ্র হিসেবেও
এটি বিবেচিত; এখান থেকে সংগৃহীত হয় নানা কাজে ব্যবহার
উপযোগী বনবৃক্ষ, আহরিত হয় প্রচুর পরিমাণ মধু, মোম ও মাছ। সাতক্ষীরা, খুলনা এবং বাগেরহাট
জেলার অংশবিশেষ জুড়ে বাংলাদেশের সুন্দরবন বিস্তৃত। পরস্পর সংযুক্ত প্রায় ৪০০
নদী-নালা, খালসহ প্রায় ২০০টি ছোট বড় দ্বীপ ছড়িয়ে আছে
সুন্দরবনে।
![]() |
সুন্দরবন |
আজ
থেকে প্রায় ২০০ বছর পূর্বেও মূল সুন্দরবনের এলাকা ছিল প্রায় ১৬,৭০০ বর্গ কিমি।
বর্তমানে সংকুচিত হয়ে প্রকৃত আয়তনের এক-তৃতীয়াংশে পৌঁছেছে। ব্রিটিশ ভারত
বিভাগের পর বনের দুই-তৃতীয়াংশ পড়েছে বাংলাদেশে, বাকিটা
ভারতে। এই বনভূমির বর্তমান আয়তন হবে প্রায় ৪,১১০ বর্গ
কিমি, এর প্রায় ১,৭০০ বর্গ কিমি
জলাভূমি। গোটা সুন্দরবন দুটি বন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। এখানে আছে চারটি প্রশাসনিক
রেঞ্জ- বুড়িগোয়ালিনি, খুলনা, চাঁদপাই
এবং শরণখোলা; আর ১৬টি ফরেস্ট স্টেশন। ব্যবস্থাপনার
সুবিধার জন্য সুন্দরবনকে নয়টি ব্লক (bock) এবং ৫৫টি
কোম্পার্টমেন্ট-এ (compartment) ভাগ করা হয়েছে। ১৮৭৫ সালে
সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ বনভূমির প্রায় ৩২,৪০০ হেক্টর এলাকাকে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে
এবং ১৯৯৯ সাল থেকে UNESCO World Heritage Site-এর
অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আদেশ (সংশোধন), ১৭৭৪-এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৭ সালে সুন্দরবনের অভয়ারণ্যগুলি (sanctuaries)
প্রতিষ্ঠিত হয়।
যে
তিনটি এলাকা এতে অন্তর্ভুক্ত সেগুলি হচ্ছে: সুন্দরবন পশ্চিম (৯,০৬৯ হেক্টর), সুন্দরবন দক্ষিণ (১৭,৮৭৮ হেক্টর) এবং সুন্দরবন
পূর্ব (৫,৪৩৯ হেক্টর)।
‘সুন্দরবন’
নামটি সম্ভবত সুন্দরী বৃক্ষের আধিক্যের কারণে (সুন্দরী-বন) অথবা সাগরের বন
(সমুদ্র-বন) কিংবা এ বনভূমির আদিবাসী চন্দ্রবেদে থেকে উদ্ভূত। সাধারণভাবে গৃহীত
ব্যাখ্যাটি হলো এখানকার প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরী বৃক্ষের (Heritiera fomes)
নাম থেকেই এ বনভূমির নামকরণ।
ভূতত্ত্ব :
উৎপত্তির দিক থেকে সুন্দরবনের ভূভাগ
সাম্প্রতিককালের এবং হিমালয় পর্বতের ভূমিক্ষয়জনিত জমা পলি থেকে এর সৃষ্টি। ভূগঠন
প্রক্রিয়াটি সাগরের জোয়ারের কারণে ত্বরান্বিত হয়েছে। এর নিম্নস্তর প্রধানত
কোয়াটারনারি যুগের (Quaternary)
তলানিতে গঠিত, যার সংমিশ্রণ ঘটেছে বালি,
পলি, সামুদ্রিক লবণ এবং কাদামাটির
সঙ্গে। ভূতত্ত্ববিদগণ এখানকার ভূগঠনবিন্যাসে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সামান্য ঢালের
সন্ধান পেয়েছেন এবং সেসঙ্গে টারসিয়ারি সময়ে সংঘটিত বাংলার অববাহিকার (Bengal
Basin) ঝুকানো অবস্থা শনাক্ত করেছেন। দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে
সংঘটিত নব্য-ভূগঠনিক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বেঙ্গল বেসিন পূর্বমুখে ঝুঁকে পড়ে।
সন্ধানমূলক কূপ খনন (borehole) গবেষণা থেকে প্রতীয়মান
হয় যে সুন্দরবনের পশ্চিম এলাকা অপেক্ষাকৃত সুস্থিত হলেও দক্ষিণ-পূর্ব কোণার অংশ
একটি সক্রিয় পলিজ এলাকা এবং ক্রমে তা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে।
![]() |
রয়েল ব্যাঙ্গল টাইগার |
অবস্থান: খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা
জেলায় অবস্থিত পৃথিবীর একক বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন হচ্ছে আমাদের
সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে এ বন অবস্থিত।
পরিমাণ: প্রায় ৬,০১,৭০০ হেক্টর
যা দেশের আয়তনের ৪.১৩% এবং বন অধিদপ্তর
নিয়ন্ত্রিত বনভূমির ৩৮.১২%।
উদ্ভিদ প্রজাতি: সুন্দরী, গেওয়া, কেওড়া, পশুর, বাইন, কাকড়া
ইত্যাদি এ বনের প্রধান প্রধান বৃক্ষ প্রজাতি।
বন্যপ্রাণী: এ বনের উল্লেখযোগ্য বন্যপ্রাণী হচ্ছে রয়েল
বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, বানর, শুকর, কুমির, ডলফিন, গুইসাপ, অজগর, হরিয়াল, বালিহাঁস, গাংচিল, বক, মদনটাক, মরালিহাঁস, চখা, ঈগল, চিল
মাছরাঙা ইত্যাদি।
নদী/খাল: এ বনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রধান প্রধান
নদীগুলো হলো- পশুর, শিবসা, বলেশ্বর, রায়মংগল
ইত্যাদি। তাছাড়া শত শত খাল এ বনের মধ্যে জালের মতো ছড়িয়ে আছে।
মাছ: শুধু বৃক্ষসম্পদ নয়, এ বন মৎস্য সম্পদেরও এক
বিরাট আধার। ইলিশ, লইট্টা, ছুরি, পোয়া, রূপচাঁদা, ভেটকি, পারসে, গলদা, বাগদা, চিতরা ইত্যাদি
মাছ পাওয়া যায়।
বিশ্ব ঐতিহ্য: সুন্দরবনের ৩ টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য নিয়ে গঠিত
১,৩৯,৭০০ হেক্টর বনাঞ্চলকে ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে বিশ্ব
ঐতিহ্য ঘোষণা করেছে।
No comments